কচু উপাখ্যান

 


বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। দুপুরে খেতে বসে দেখি
বোন কচুশাক রেঁধেছে, সাথে আছে মুরগির মাংস। আমি আবার কচু শাক খাইনা। তাই সরাসরি মুরগির মাংসের দিকে হাত বাড়ালাম। এটা দেখে ভাগ্নে 'হায় হায়' করে উঠলো। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই বললো, "মামা, তুমি জানোনা বোধ হয়। এই বাসায় থাকার অন্যতম শর্ত হলো- তোমাকে কচু শাক খেতেই হবে। তুমি অতিথি মানুষ। তোমার প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি, কচু শাকটা ভালোয় ভালোয় খেয়ে নাও।"


আমি যথেষ্ট অপমানিত হয়ে বললাম, "এটা আবার কেমন নিয়ম হলো? আগে জানলে তো তোদের বাসায় আসতামই না।"


ভাগ্নে বললো, "এখন চলেই যখন এসেছো। কচু তো তোমাকে খেতেই হবে। তোমাকে নিয়ম বলে দেই- এই বাসায় থাকার শর্ত হল তোমাকে কচু খেতে হবে, সারাদিনে ৫-৭ বার কচুর গুণকীর্তন করতে হবে এবং আগামী বছর কচুর জন্মভূমি তথা সবচেয়ে বড় খামার পরিদর্শনে যেতে হবে। এছাড়াও বছরে ২ বার নির্দিষ্ট দিনে কচুর উৎসব যথাযোগ্য ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করতে হবে। তার ভেতর এক উৎসব আবার প্রাণী হত্যার উৎসব। তাছাড়াও কচু বাদে অন্য সবজী যারা খায় তাদের ঘৃণা করতে হবে, অভিশাপ দিতে হবে। তাদের কচু খাওয়ার দাওয়াত দিতে হবে। দাওয়াত কবুল না করলে যুদ্ধ করতে হবে তাকে জোর করে কচু খাওয়ানোর জন্য।"


আমি নির্বাক হয়ে আমার বোন আর দুলাভাইয়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম তারাও নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করছে ভাগ্নের কথায়। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম।


ভাগ্নে আবার বলা শুরু করলো, "আরো অনেক অদ্ভুত নিয়ম তোমাকে মানতে হবে। যেমন কেউ যদি কচু সম্পর্কে কোন বিরুপ মন্তব্য করে তাহলে তার গর্দান উড়িয়ে দিতে হবে। আসলে আমরা কচুকে একটু বেশিই ভালবাসি কিনা। তোমার কচুনূভূতি একদম টনটনা থাকতে হবে। আমরা ছোলার কিংবা গাজরের হালুয়াতেও হালকা কচু দিয়ে খাই, আবার বিরিয়ানিতেও কচু খাই। সব কিছুর সাথে কচু মিক্স না করলে খাবার হজমই হতে চায়না। এগুলো খাওয়ার অভ্যাস তোমাকে করতে হবে।


কেউ যদি পেস্ট্রীর সাথে কচু মেলাতে না চায় তখন তোমাকে নেই ঠেলতে হবে। মানবে না মানে? মানতেই হবে। কচুর পুষ্টিগুণ তো সেই ১৬০০ বছর আগেই প্রমাণিত। আর আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে পেষ্ট্রী, স্যান্ডউইচ, বার্গার খাওয়া শিখেছি তো মাত্র কয়েক বছর আগে। তার মানে আমার কচুই সেরা।


পৃথিবীর সব কিছুর সাথে কচুর সম্পর্ক খুঁজে বের করতে হবে। বিজ্ঞানের সাথে কচু মেলাতে হবে। যেমন ধরো "নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে যেয়ে চাঁদের মাটিতে কচু গাছ দেখেছেন। এরপর থেকে তিনি কচু ছাড়া আর কিচ্ছু মুখে দেননা।" অথবা "মাইকেল জ্যাকসন কচু খেয়ে স্টেজে গান গাইতে উঠতেন। শেষ জীবনে তিনি কচু খেয়েই বেঁচে ছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।" এগুলো তোমাকে প্রচার করতে হবে।"


আমি এক চুমুক পানি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে ভাগ্নের কথায় মনোযোগ দিলাম।


"তবে এই কচু গ্রুপের ভেতরেও আবার প্রচুর গ্রুপিং আছে। কেউ কচুর লতি গ্রুপ, কেউ কচুরমুখী, কেউ আবার কচুর ডাটা, কেউ কচুশাক। শাক গ্রুপ মুখী গ্রুপকে দেখতেই পারেনা। আর ডাটা গ্রুপ তো ঘোষণা দিয়েই রেখেছে লতি আসলে কচুর কোন অংশই নয়। তাদের কতল করে ফেলতে হবে। আবার এসব শাখাগুলোর উপশাখাও অনেক। এছাড়াও রয়েছে ওলকচু, মানকচু ইত্যাদি নামের হাজার খানেক গ্রুপ। তারা সবাই নিজেদের একমাত্র সত্য কচু বলেই দাবী করে। তবে তুমি তোমার লাইনে ঠিক থাকবা। মনে রাখবা তোমারটাই একমাত্র সঠিক কচু। আর বাদবাকি সব ভুয়া।


তোমাকে মনেপ্রাণে মানতে হবে কচুই পৃথিবীর একমাত্র সবজি। এর তরকারিই দুনিয়ার সেরা। বাদবাকি কোন সবজি আসলে অরিজিনাল সবজিই নয়। কচু খেয়ে তোমার গলা কুটকুট করলেও, চুলকে ছিড়ে যেতে চাইলেও খবরদার টু শব্দ করবা না। একদম চেপে যাবা। বলেছো কি মরেছো। কচুখোরদের হাতে তুমি কচুকাটা হয়ে যেতে পারো। মাত্রতো কটা দিন। চুপচাপ নাক চেপে ধরে কচুটা ঢক করে গিলে ফেলবা।


এবার আমার সাথে সাথে শপথবাক্য পাঠ করো, 'কচুই সেরা, কচুই সেরা। কচু ছাড়া আর কোন সবজি নেই। কচু ছাড়া আর কোন সবজি নেই। ......... '


- নাফিস সাদিক শাতিল

Nafis Sadique Shatil

কচু উপাখ্যান, ২০১৯ সাল।

মন্তব্যসমূহ